আবু বকরের সত্য রূপ

0
378
আবু বকরের সত্য রূপ
আবু বকরের সত্য রূপ

আবু বকরের সত্য রূপ

 আবুবকর ছিলেন ইনসানী দুনিয়ার সর্বপ্রথম আদর্শ মানুষ-এই মন্তব্য আগেই আমরা করে রেখেছি। আবুবকরের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সম্পূর্ণ জীবন- চিত্র এখন আমাদের সামনে উপস্থিত । আমাদের মন্তব্য কতদূর সত্য এখন তা

পরীক্ষা করা যেতে পারে। রসুলুল্লাহ বলেছেন, “পয়গম্বরদেরকে বাদ দিলে, আবুবকর ছাড়া অন্য কোন শ্রেষ্ঠতর মানুষের মুখের উপর সূর্য উঠে নি।” তিনি আরও বলেছেন, “রসুলুল্লাহকে বাদ দিলে আবুবকরই মানব জাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।” এখানেই আমাকে মন্তব্যের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, যেসব উপাদান মানব চরিত্রকে সুন্দর, উন্নত, মহৎ বা সম্পূর্ণ কর তুলতে পারে তার সবগুলােই আবুবকরের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। আল্লাহর এক কঠোর আহ্বানে তিনি সাড়া দিয়েছিলেন। রূপকভাবে বলতে গেলে বলা যায়, হযরত আদম থেকে হযরত মুহম্মদের ইন্তেকাল পর্যন্ত যে দীর্ঘ জামানা, সে জামানা ছিল মানব জাতির নাবালকত্ব বা অভিভাবকত্বের জামানা। আল্লাহ যেমন মানুষকে দুনিয়ায় পাঠিয়ে কতকটা নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করেছিলেন। মানবজাতিকে ধ্বংস করার জন্য শয়তান পথে পথে মােড়ে মােড়ে প্রতারণার জাল পেতে বসে আছে-তা তিনি জানতেন। অনভিজ্ঞ মানুষ শয়তানের কুহকে পড়ে পাছে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এই আশঙ্কায় তিনি যুগে যুগে অনেক পয়গম্বর পাঠিয়েছেন এবং অনেক ঐশীবাণী দিয়ে মানবজাতিকে সতর্ক করে দিয়েছেন। মানুষ যদি চিরদিনই অভিভাবকের আশ্রয়ে থাকে তবে তাতে আভিভাবকের কোন গৌরব নেই, মানুষেরও কোন গৌরব। 

নেই। একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্তই অভিভাবকত্ব চলতে পারে । হযরত মুহম্মদই হচ্ছেন সেই অভিভাবক যুগের শেষ পয়গম্বর। কিরকম করে মানুষ তার জীবন গঠন করবে, কিরকম করে জীবন সংগ্রামে সে জয়ী হবে-সব কিছুর পরিপূর্ণ আদর্শ দেখিয়ে দিয়ে আল্লাহর শেষ নবী অন্তর্হিত হলেন। আল্লাহ্ পরিষ্কারভাবে ঘােষণা করে দিলেন, “হে মানুষ, অভিভাবকত্বের যুগ এখানেই তােমাদের শেষ হলাে, এখন তােমরা সাবালক। এখন সবকিছু নিজে কর; নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াও।” মানবজাতির শক্তি ও সম্ভাবনার কাছে আল্লাহর এ এক উদ্বাত্ত আহ্বান। যুগযুগান্তরের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও প্রস্তুতির এ যেন প্রথম পরীক্ষা। পয়গম্বরদের আশ্রয়ে থেকে মানুষ যদি শয়তানের উপর জয়লাভও করে, তবু শয়তান এই অনুযােগ করতে পারে যে, পয়গম্বরদের সাহায্য নিয়েই মানুষ জয়ী হয়েছে আল্লাহ্ শয়তানকে এই সুযােগ দিতে চান না বলেই যেন পয়গম্বরদেরকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিলেন। নিরপেক্ষ থেকে তিনি যেন মানুষকে এবার পরীক্ষা করতে চান। এই আহ্বানে হযরত আবুবকর সাড়া দিলেন। তাঁকে তাই এক কটিন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হলাে। সুখের বিষয়, আবুবকর এই ভূমিকায় সম্মানের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এতে আল্লাহও খুশি হয়েছেন, মানব জাতির মুখও গৌরবে উজ্জ্বল হয়েছে। মানবীয় আবেষ্টনীর মধ্যে থেকে তিনি রসুলুল্লাহর বিশাল ব্যক্তিত্বের খুব সার্থকভাবে রূপ দিয়ে গেছেন। রসুলুল্লাহর বিরাট ব্যক্তিত্বের খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছেন বলে স্বাভাবতই তিনি কিছুটা ম্লান হয়ে রয়েছেন; কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করলে একথা সহজেই বুঝা যাবে যে, তাঁর ভুমিকাও রসুলুল্লাহর ভূমিকা থেকে কম গৌরবের নয় ।

 আবুবকরকে ইসলামের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা যেতে পারে । রসুলুল্লাহ্র ইন্তেকালের সাথে সাথে সমগ্র আরব দেশ থেকে তাঁর প্রচারিত ইসলামের শিক্ষা, রীতি-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান-সবই একরকম অন্তর্হিত হয়েছিল। ইসলামকে অস্বীকার করে প্রায় সবাই তাদের পূর্ব ধর্মে ফিরে গিয়েছিল । চারজন ভণ্ড নবী আবির্ভূত হয়ে নামাজ, রােজা, যাকাত ও অন্যান্য অনুশাসন অস্বীকার করেছিলেন অনেক বেদুঈন পরিবার বিদ্রোহী হয়েছিল । খ্রীস্টান ও পারসিকরা মদীনা আক্রমণ করার জন্য তৈরি হয়েছিল। এক কথায়, মুষ্টিমেয় কোরেশ ও আনসার ছাড়া সমগ্র আরবই ইসলামের গণ্ডির বাইরে চলে গিয়েছিল। এই কঠিন মুহূর্তে হযরত  আবুবকর মাথায় তুলে নিলেন খেলাফতের গুরু দায়িত্বভার । তিনি হলেন ‘খলিফাতর রসুলুল্লাহ’ অর্থাৎ রসুলের খলিফা । রূপকভাবে বললে বলা যায়, রসুলুল্লাহ্ ছিলেন শিক্ষাগুরু, আর আবুবকর, ওমর ওসমান, আলী প্রমুখ সাহাবারা ছিলেন তার ছাত্র বা শিষ্য। আর মরুর বিস্তীর্ণ স্লেট বা পটভূমিকায় রসুলুল্লাহ যে সব বাস্তব চিত্র ও বাণীকে রূপ দিয়েছিলেন, শিষ্যদেরকে পরীক্ষা করার জন্য তার সবই মুছে ফেলা হলাে এবং সেই সব চিত্র ও বাণীকে পুর্নবার যথাস্থানে অঙ্কিত করার জন্য মহাপরীক্ষক আল্লাহর আহ্বান এল।

 

শিষ্যদের মধ্যে চারজন ছিলেন গুণে গরিমায় শ্রেষ্ঠ । আবুবকর ছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথম। পরীক্ষা ক্ষেত্রে তাই সর্বপ্রথম তিনিই অবতীর্ণ হলেন এবং মুছে ফেলা সব চিত্র ও বাণীকে তিনি অবিকল রসুলুল্লাহর মতই রূপ দিয়ে সবাইকে স্তম্ভিত করেছিলেন। আবুবকরের তিরােধানের পর এক এক করে ওমর, ওসমান, আলী সেই চিত্রকে আরও পল্লবিত ও সুশােভিত করে তুললেন। এই ভিত্তিভূমির উপরেই পরবর্তী খলিফারা বিশাল ইসলামী সুলতানাৎ গড়ে তুললেন। এখানেই হযরত আবুবকরের কৃতিত্ব। শিষ্যের মর্যাদার মধ্যেই তাে গুরুর মর্যাদা! আবুবকরের খলিফাতুর রসুলুল্লাহ্ উপাধি গ্রহণের সার্থকতাও তাে এখানেই। রসুলুল্লাহ্ ছিলেন ‘খলিফাতুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর খলিফা’ কিন্তু আবুবকর আল্লাহর খলিফা হতে চান নি। তিনি চেয়েছেন রসুলের খলিফা হতে। রসুল-প্রীতির এ এক অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন। কার্যতও তিনি রসুলের অনুকরণ ও অনুসরণ করে গেছেন। প্রথমবার আল্লাহর খলিফা ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, দ্বিতীয়বার রসুলের খলিফা সেই ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আবুবকরের চরিত্রে যে সব মহৎ গুণ ছিল তার মােটামুটি পরিচয় আমরা আগে দিয়েছি, এখানে আরও কিছু আলােকপাত করব। 

Leave a Reply