ইমানের মৌলিক বিষয়

0
600
ইমানের মৌলিক বিষয়
ইমানের মৌলিক বিষয়

ইমানের মৌলিক বিষয়

ইমানের মৌলিক বিষয় আল্লাহর উপর ইমান আল্লাহর উপর ইমানের মূল কথা হলাে তার তাওহিদ তথা একত্ববাদকে স্বীকার করা। তাওহিদের মূল কথা হলাে আল্লাহ এক, অদ্বিতীয় ও অতুলনীয়। তাঁর কোনাে শরিক নেই। তিনি কারাে মুখাপেক্ষী নন; বরং সকল সৃষ্টিই তাঁর মুখাপেক্ষী।

কুরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :

قل هو الله أحد الله الصمد لم يلد ولم يولد ولم يكن له كفوا أحد-
অর্থ: (হে রাসুল) আপনি বলুন, তিনিই আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারাে মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাকেও জন্ম দেয়া হয়নি। আর তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই । (সুরা ইখলাস)
তাওহিদ আমাদের শিক্ষা দেয়, আল্লাহ আমাদের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। বিশ্বজগতের সবকিছুর স্রষ্টা তিনি। তিনিই এ নিখিল বিশ্বের একমাত্র মালিক ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। তিনিই পালনকর্তা ও রিযিকদাতা। সৃষ্টিজগতের সব কিছুর অস্তিত্ব, ধ্বংস, জন্ম-মৃত্যু সব তারই হাতে। তিনি ছাড়া কোনাে মা’বুদ নেই।
আমাদের ইবাদত-বন্দেগি পাওয়ার একমাত্র অধিকারী তিনিই। ফেরেশতাদের প্রতি ইমান ফেরেশতা শব্দটি ফারসি। আরবিতে ‘মালাকুন’, যার বহুবচন ‘মালাইকাতুন’। মালাইকা বা ফেরেশতাগণ আল্লাহর সৃষ্টি এক বিশেষ জাতি। তাঁরা নুরের তৈরি। তারা পুরুষও নন, নারীও নন। তাঁদের আহার-ন্দ্রিারও কোনাে প্রয়ােজন হয় না।
আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়ােজিত রেখেছেন। তারা সবসময় আল্লাহর আদেশ মেনে চলেন। কখনাে তার অবাধ্য হন না। তাদের প্রকৃত সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। ফেরেশতাদের মধ্যে চারজন প্রধান ও শ্রেষ্ঠ ।

চারজন প্রধান ফেরেশতা:

হযরত জিবরাইল (আ.): তিনি নবি-রাসুলগণের নিকট আল্লাহর বাণী নিয়ে আসতেন।
২. হযরত মিকাইল (আ.): তিনি আল্লাহর হুকুমে সকল জীবের রিযিক। বণ্টন ও মেঘ-বৃষ্টি পরিচালনা করেন ।
৩. হযরত আযরাইল (আ.): তিনি আল্লাহর হুকুমে সকল প্রাণীর রুহ কব্য করেন।
৪. হযরত ইসরাফিল (আ.): শিঙ্গায় ফুঙ্কার দেয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার হুকুমের অপেক্ষায় আছেন। তাঁর ফুস্কারে কিয়ামত হবে
আসমানি কিতাবের উপর ইমান : মানবজাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রাসুলগণের নিকট যেসব কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলােকে আসমানি কিতাব বলে । আসমানি কিতাব ১০৪খানা। প্রধান কিতাব চারখানা আর সহিফা একশখানা। ছােট কিতাবকে সহিফা বলা হয় । আসমানি কিতাবসমূহের উপর ইমান রাখা আমাদের জন্য আবশ্যক।

প্রধান চারখানা আসমানি কিতাব হলাে

তাওরাত, যাবুর, ইনজিল ও কুরআন মজিদ। এগুলাের মধ্যে তাওরাত হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এর উপর অবতীর্ণ হয়। যাবুর হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর উপর অবতীর্ণ হয়। ইনজিল হযরত ইসা আলাইহিস সালাম এর উপর অবতীর্ণ হয়। আর কুরআন মজিদ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর অবতীর্ণ হয়।
কুরআন মজিদ কুরআন মজিদ আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব । এটি লাওহে মাহফুযে সুরক্ষিত। এ কিতাব বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ । এ কিতাবের মধ্যে সন্দেহ সংশয়ের কুরআন কোনাে অবকাশ নেই।

এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার ঘােষণা

–  অর্থাৎ এটি এমন একটি কিতাব যাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই।
মজিদের আগমনে অন্য সকল আসমানি কিতাব রহিত হয়ে গেছে। এ কিতাব আমাদের নবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শ্রেষ্ঠ মু’জিযা।
কুরআন মজিদ এর শিক্ষা ও আদর্শ কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত সকল যুগের সকল
মানুষের জন্য কুরআন মজিদ পথপ্রদর্শক। নবি ও রাসুলগণের উপর ইমান নবি ও রাসুলগণ মানুষের হিদায়াতের জন্য আল্লাহর মনােনীত ও নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গ। যখন মানুষ শয়তানের প্ররােচনায় আল্লাহকে ভুলে যায় তখন তাদেরকে আল্লাহর পরিচয় জানিয়ে দেয়া এবং তাদের সরল সঠিক পথ দেখানাের জন্য নবি রাসুলগণ দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছেন।
যাদের নিকট নতুন শরিয়ত এসেছে তারা হলেন রাসুল। আর যারা পূর্ববর্তী রাসুলের শরিয়ত অনুসরণ করে দীন প্রচার করেছেন তাঁরা নবি যুগে যুগে অনেক নবি-রাসুল দুনিয়ায় এসেছেন। কুরআন মজিদে তাঁদের ২৫ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। সর্বপ্রথম নবি হযরত আদম আলাইহিস সালাম এবং সর্বশেষ নবি ও রাসুল প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ।
নবি ও রাসুলগণের প্রতি বিশ্বাস রাখা ইমানের অঙ্গ। নবি ও রাসুলগণ সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস হলাে- নবি-রাসুলগণ সকলেই আল্লাহ রাব্দুল । আলামীন কর্তৃক মানবজাতির হেদায়াতের জন্য মনােনীত। তারা প্রত্যেকেই যথাযথভাবে নবুওয়াত ও রিসালতের দায়িত্ব আনজাম দিয়ে গেছেন। তাঁরা মাসুম তথা নিষ্পাপ। নবি-রাসুলগণ আল্লাহর খাস বান্দা। তারা আমাদের মতাে সাধারণ মানুষ নন ।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাতামুন্নাবিয়্যিন-সর্বশেষ নবি । তিনি মানবজাতির সরদার এবং সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তার পরে আর কোনাে নবি আসবেন না। আখিরাতের উপর ইমান মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে আখিরাত বলা হয়। হায়াতে বরযখ তথা করে। জীবন, মহাপ্রলয়, শিঙ্গায় ফুৎকার, মৃত্যুর পর আবার জীবিত হওয়া।
হাশর, হিসাব-নিকাশ, বেহেশত ও দোযখ এ সবকিছুই আখিরাতেও। অন্তর্ভুক্ত। হাশরের ময়দানে মানুষের ভালােমন্দের হিসাব নেয়া হবে। এরপর যার দুনিয়াতে ভালাে কাজ করেছে তারা বেহেশতে যাবে। আর যারা খারাপ কাজ করেছে তারা দোযখে যাবে। আখিরাতের উপর বিশ্বাস ইমানের অন্যতম মূল বিষয়। যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তারা মুমিন নয়।

মুমিন-মুত্তাকিদের পরিচয় বর্ণনায়

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وبالأخرة هم يؤتيؤن –
তারা আখিরাতের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। (সুরা বাকারা, আয়াত-৪) কবর অর্থ সমাধি, মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার স্থান। পরিভাষায় মৃতব্যক্তিকে মাটির নিচে দাফন করার স্থানকে কবর বলা হয়। মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময়কে আলমে বরযখ বা কবরের জিন্দেগি বলা হয়।
কবরে পুণ্যবানদের জন্য রয়েছে প্রশান্তি এবং পাপীদের জন্য লাঞ্ছনা। পুন্যবানদের কবর হবে অত্যন্ত প্রশস্ত ও নিয়ামতে পরিপূর্ণ এবং পাপীদের কবর হবে সংকীর্ণ ও আযাবে পরিপূর্ণ। মৃতদেহ মাটিতে দাফন করা, পানিতে ফেলা, আগুনে পােড়ানাে অথবা জীবজন্তু খেয়ে ফেলা সকল অবস্থাই কবরের জিন্দেগীর মধ্যে গণ্য। হাশর
হাশর শব্দের অর্থ একত্রিত করা, সমবেত করা।
পরিভাষায় কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা মানুষের সকল কাজের হিসাব গ্রহণ ও তাদের প্রতিদান প্রদানের উদ্দেশ্যে পুনরায় জীবিত করে এক বিশাল ময়দানে। সমবেত করবেন। একে হাশর বলা হয়। হাশরের ময়দানে প্রত্যেককে। নিজ নিজ কৃতকর্ম অনুযায়ী প্রতিদান দেয়া হবে।

মিযান:

মিযান অর্থ দাড়িপাল্লা বা পরিমাপ করার যন্ত্র। পরিভাষায় কিয়ামতের দিন আল্লাহ যে কুদরতি প্রক্রিয়ায় পাপ-পুণ্যের হিসাব করবেন তাকে মিযান বলা হয়। সেদিন যাদের পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে তাদেরকে প্রতিদানস্বরূপ জান্নাত প্রদান করা হবে। আর যাদের পাপের পাল্লা ভারী হবে তাদেরকে শাস্তিস্বরূপ জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
এ মর্মে কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে :
أما من قلت موازينه فهو في بيشة راضية- وأما من ق مؤازه قاه
هاوية.
অর্থ : : অতঃপর যার পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে, সে থাকবে শান্তিময় জীবনে। আর যার পুণ্যের পাল্লা হাল্কা হবে, তার অবস্থান হবে। জাহান্নাম। (সুরা কারিআহ, আয়াত ৬-৯)
পুলসিরাত : সিরাত শব্দের অর্থ রাস্তা, পথ, সেতু ইত্যাদি। হাশরের ময়দান জাহান্নাম। দ্বারা পরিবেষ্টিত হবে। জাহান্নাম পাড়ি দিয়ে জান্নাতে যাওয়ার জন্য জাহান্নামের উপর একটি সেতু থাকবে তাকে সিরাত বা পুলসিরাত বলে। পুলসিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখা ইমানের অংশ। পুলসিরাত চুলের চেয়ে সূক্ষ্ম এবং তলােয়ারের চেয়েও অধিক ধারালাে হবে।
পাপিষ্ঠ, কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকরা পুলসিরাত পার হতে গিয়ে জাহান্নামে পড়ে যাবে । পক্ষান্তরে মুমিনগণ অনায়াসে পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। পুলসিরাত সত্য। কিয়ামতের দিন সমগ্র সৃষ্টিকে পুলসিরাত অতিক্রম করার হুকুম দেয়া হবে। জান্নাতিগণ তা পার হয়ে জান্নাতে পৌঁছে যাবে । কোনাে কোনাে মানুষ বিজলীর গতিতে পার হবেন।

কেউ প্রবল বাতাসের ন্যায় অতিক্রম করবে। কেউ দ্রুতগামী ঘােড়ার গতিতে পার হবে। সারকথা হলাে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার মর্যাদা অনুযায়ী পুলসিরাত পার হবে। পক্ষান্তরে পুলসিরাতের উপর দোযখিদের পা কাঁপতে থাকবে এবং তারা দোযখে পড়ে যাবে।

কুরআন মজিদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,
وإن منه إلا واردها
অর্থাৎ, তােমাদের সকলকে তা অতিক্রম করতে হবে । এ আয়াত দ্বারা জানা যায় পুলসিরাত অতিক্রম করা সকলের জন্য আম তথা সার্বজনীন বিষয়।
জান্নাত : জান্নাত শব্দের অর্থ বাগান, উদ্যান। পরিভাষায় হাশরের মাঠে হিসাব- নিকাশের পর মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের যে চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির আবাসস্থল প্রদান করবেন তাকে জান্নাত বলা হয়। ফারসি ভাষায় একে বেহেশত বলে।

জান্নাত আটটি

যথা- ১. আদন ২. খুলদ ৩. নাইম ৪. মাওয়া ৫. দারুস সালাম ৬. দারুল কারার ৭. দারুল মাকাম ৮, ফিরদাউস।
জাহান্নাম : জাহান্নাম শব্দটির অর্থ দগ্ধ করা, পুড়ানাে। পরিভাষায় হাশরের মাঠে হিসাব-নিকাশের পর আল্লাহ তাআলা পাপীদের যে চিরস্থায়ী অশান্তির আবাসস্থল প্রদান করবেন তাকে জাহান্নাম বলা হয়। ফারসি ভাষায় একে দোযখ বলে।

জাহান্নামের সাতটি স্তর রয়েছে

যথা- ১. জাহান্নাম ২. লাযা ৩. হুতামাহ ৪. সাইর ৫. সাকার ৬. জাহিম ৭. হাবিয়াহ। জান্নাত ও জাহান্নাম বাস্তব সত্য। এর প্রতি ইমান রাখা অবশ্য কর্তব্য।

তাকদিরের উপর ইমান :

তাকদির আরবি শব্দ। এর অর্থ নির্ধারণ করা। মহান আল্লাহ প্রত্যেক সৃষ্টির ভাগ্যে যা কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন তাকে তাকদির বলে । তাকদিরের উপর বিশ্বাস রাখা ইমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে সৃষ্টির সকল বিষয় আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী হয়।
প্রত্যেকের জন্ম-মৃত্যু, রিযিক, ভালাে-মন্দসহ সকল বিষয় তাকদির অনুযায়ী হয়ে থাকে। তাকদিরের উপর বিশ্বাস রাখা ফরয। মৃত্যুর পর আবার জীবিত হওয়া আল্লাহ রাব্বল আলামীন মানুষদেরকে তাদের মৃত্যুর পর কিয়ামতের দিন জীব-জঙসহ আবার জীবিত করবেন।
সৃষ্টিজগতের ধ্বংস ও পুনরুত্থানের জন্য হযরত ইসরাফিল আলাইহিস সালাম শিঙ্গায় ফুঁক দিবেন। যখন আল্লাহ তাআলার হুকুমে হযরত ইসরাফিল আলাইহিস সালাম প্রথমবার শিঙ্গায় ফুঁক দিবেন তখন প্রথমে মানব, জিন, সকল প্রাণী মারা যাবে। পরবর্তীতে আসমান ফেটে যাবে, চন্দ্র-সূর্য নিষ্প্রভ হয়ে পড়বে, যমীন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে, পাহাড়-পর্বত তুলার মত উড়তে থাকবে।
শেষ পর্যন্ত আল্লাহ ব্যতীত সকল সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে । যখন আবার ফুক দেয়া হবে তখন সবাই জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে। সেখানে সকলের আমলের হিসাব নেয়া হবে। কুরআন মজিদে এ দিবসকে ‘কিয়ামত দিবস’ ও ‘হিসাব-নিকাশের দিন সহ বিভিন্ন নামে বর্ণনা করা হয়েছে।
কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে, তা কেবল আল্লাহ তাআলাই জানেন। কুরআন মজিদে ইরশাদ
হয়েছে : ثم إنكم يوم القيامة بتمون-
অর্থ : অতঃপর কিয়ামতের দিন তােমাদের আবার জীবিত করা হবে ।

Leave a Reply