যমযম কূপের ইতিহাস পর্ব ৩

    0
    465
    যমযম কূপের ইতিহাস পর্ব ৩
    যমযম কূপের ইতিহাস পর্ব ৩

    যমযম কূপের ইতিহাস পর্ব ৩

    নিকটবর্তী বধ্যভূমিতে নিয়ে চললেন। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য । আব্দুল মুত্তালিবের। এক হস্তে সুতী খঞ্জর, অপর হস্তে ধরে চলেছেন প্রাণপ্রিয় পুত্র । আব্দুল্লাহকে। কুরাইশ গােত্রের লােকেরা এ সংবাদ শুনল আব্দুল্লাহকে কোরবানি দেয়া হচ্ছে । তারা এসে আব্দুল মুত্তালিবকে তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে বাধা দিল ।
    বিশেষত আত্মীয় স্বজনগণ তার তীব্র বিরােধিতা করতে লাগল। অতঃপর তারা তাকে হিজাযের সব চাইতে প্রসিদ্ধ জ্যোতিষী রমণীর নিকট নিয়ে গেল ।
    সে সময় পর্যন্ত জিন জাতির আকাশে যাতায়াত অবারিত ছিল। তারা আকাশে গিয়ে উর্ধ্বকাশের গােপন তথ্য চুরি করে শুনিয়ে আসত এবং সে প্রেক্ষিতে কাজ করার জন্য জ্যোতিষিগণকে পরামর্শ দিত। আব্দুল মুত্তালিব জ্যোতিষী মহিলার নিকট আদ্যোপান্ত ঘটনা বিবৃত করলেন। মহিলা বলল, আজ চলে যাও, আমি আমার
    জিনের সঙ্গে এ ব্যাপারে পরামর্শ করে কি করতে হবে ঠিক করে লই ।
    তােমরা আগামীকাল আসও । দ্বিতীয় দিন যখন তারা জ্যোতিষীর নিকট উপস্থিত হল,
    তখন সে বলল, তােমাদের নিকট একটি লােকের মৃত্যুপণ কয়টি উট দ্বারা পরিশােধ করতে হয়? তারা বলল, – । তখন সে বলল, দশটি উটের মুকাবিলায় বালককে রেখে লটারী কর। যদি উটের নাম উঠে, তবে উট কুরবানী কর।
    আর যদি বালকের নাম উঠে, তবে উটের পূর্ব সংখ্যার সঙ্গে সমসংখ্যক আরও উট যােগ করে পুনরায় লটারী কর । যদি এবারও উটের পরিবর্তে বালকের নাম উঠে, তবে পূর্ব সংখ্যার সাথে আরও দশটি উট যােগ কর। এরূপে প্রত্যেকবার উটের সংখ্যা বৃদ্ধি করে যাও, যতক্ষণ না বালকের নামের পরিবর্তে
    উটের নাম উঠে।
    যখন উটের নাম লটারীতে উঠবে, তখন সে উটগুলি কুরবানী করে দাও। এ পরিমাণ উটই হবে তার মুক্তিপণ । অতঃপর আব্দুল মুত্তালিব কুরাইশ গােত্রের লােকজন নিয়ে ফিরে আসলেন এবং কা’বাঘরের নিকট
    আসআফ ও নাইলার পার্শ্বে বধভূমিতে এসে আব্দুল্লাহর উটের মধ্যে লটারীর ব্যবস্থা করলেন। একাদিক্রমে উটের সংখ্যা যখন একশত পৌছিল তখন লটারীতে আব্দুল্লাহর নামের পরিবর্তে উটের নাম উঠল ।
    কিন্তু তাতে আব্দুল মুত্তালিবের অন্তরে প্রশান্তি আসল না । কাজেই পুনরায় লটারী দেওয়া হল ।
    এবারও লটারীতে উটের নাম উঠল। এখন আব্দুল মুত্তালিব প্রশান্তি লাভ করলেন
    এবং তিনি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এরূপে আব্দুল্লাহ মৃত্যুর ধার্য হল একশত উট ।
    অথচ ইতিপূর্বে মুক্তিপণ ছিল দশটি উট । ইসলামের যুগে ইসলামী   শরীআয়ারও এ বিধি ব্যবস্থাই বহাল রয়েছে। এ হিসাবেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, আমি দুই যবেহের সন্তান। অর্থাৎ হযরত
    ইসমাঈল (আ) ও আব্দুল্লাহ । মাওয়াহিব গ্রন্থকার বলেন, আল্লামা যামাখশারী তাঁর প্রখ্যাত তাফসীরে কাশশাফে
    হাকিম মুস্তাদরিকের বরাত দিয়ে হযরত মুআবিয়া রা. হতে একটি ভাষ্য বর্ণনা
    করেছেন যে একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট বসেছিলাম। এক আরব বেদুঈন এসে তার অভাব অনটনের অভিযােগ করে বলল, হে”দুই যবেহের সন্তান আল্লাহ তা’আলা আপনাকে যে সমস্ত গনীমতের সম্পদ দান করেছেন তা হতে আমাকে কিছু দান করুন । তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃদু হাসলেন। তার কথার প্রতিবাদ করলেন না ।
    বিঃ দ্রঃ সংখ্যাগরিষ্ঠ আলিমদের মতে ‘যাবীহ’ (বলিকৃত) হযরত ইসমাঈল (আ) এর উপাধি। কিন্তু কোন কোন আলিমের মতে, যাবীহ’ উপাধি হল হযরত ইসহাক (আ) এর। যদি দ্বিতীয়পক্ষের কথাই যথার্থ হয়, তবে আমি দুই যাবীহ’ এর সন্তান” এ কথা অর্থ হবে, হযরত ইসমাঈল (আ) ও তার ভাই । হযরত ইসহাক (আ) কেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পিতার মর্যাদা দিয়েছেন। আর আরবের পরিভাষায় চাচাকেও পিতা বলার প্রথা কোন নূতন কথা নয়।
    এমনকি পবিত্র কুরআনেও তার উদাহরণ পাওয়া যায় । যেমন
    إذ قال إييه ما تعبدون من بعدي قالوا نعبد إلهك وإلة آبائك إبراهيم
    وإسماعيل وإسحق
    “হযরত ইয়কুব (আ) যখন তার সন্তাগণকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, আমার পর তােমরা কার ইবাদত করবে ? তারা বলল, আমরা তাে আপনার মা’বূদ এবং আপনার পিতা ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের মা’বুদের ইবাদত করব” (সুরা   ……বাকারাঃ ১৩৩)।
    পবিত্র কুরআনের ভাষায় চাচাকে পিতার স্থানে স্থান দেওয়া হয়েছে। কেননা, হযরত ইসমাঈল ছিলেন হযরত ইয়াকুব (আ) এর চাচা এবং হযরত ইসহাক (আ) এর ভাই । হযরত ইসহাক (আ) কে যাবীহ’ মেনে নিলে এ ব্যাখ্যা ছাড়া আর কোন গত্যন্ত থাকে না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
    নিজেকে যাবীহ’ এর সন্তান বলেছেন, অথচ তিনি ছিলেন তাঁর চাচা এবং নবী ছিলেন তার ভ্রাতুপুত্র।
    কিন্তু ইবনে কায়ুম প্রথম পক্ষের মতকে প্রাধান্য দিয়ে বলেন যে, এ কথা দিবালােকের ন্যায় সত্য যে, হযরত ইবরাহীম (আ) এর কুরবানী মক্কায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং হযরত ইবরাহীম (আ) এর মহান ত্যাগের আদর্শেই কুরবানির।
    দিনে মক্কায় কুরবানী অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেমন সাফা ও মারওয়ার মধ্যে দৌড়াদৌড়ি, রামিয়ে জামরাত (প্রস্তর নিক্ষেপ) ও মক্কায় অনুষ্ঠিত হয়।
    কারণ,
    এসব কর্মকাণ্ড হযরত হাজেরা ও হযরত ইসমাঈল (আ) এর স্মৃতি বিজড়িত এবং আল্লাহর স্মরণিকা হিসাবে বিদ্যমান। যদি এ যবেহ সিরিয়ায় অনুষ্ঠিত হত তবে।
    আজকের রবানীও সিরিয়ায় অনুষ্ঠিত হত। অধিকন্তু পবিত্র কুরআনে হযরত ইসমাঈলকে ‘হালীম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। আর হালীম’ বলা হয় সে।
     অথচ হযরত ইসহাককে ‘আলীম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। তা ছাড়া। ব্যক্তিকে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের জীবন কুরবানী করতে অগ্রসর। মানুষের মজাগত স্বভাব অনুযায়ি জ্যেষ্ঠ সন্তানই সর্বাধিক প্রিয় হয়। এ জন্যই। হযরত ইবরাহীম (আ) এর অত্তরে যখন বড় ছেলে হযরত ইসমাঈল (আ) এর।
    সম্পর্ক গভীরত হল তখন পিতৃবাৎসল্যের স্বাভাবিক তাকীদ অনুযাই তিনি। যবেহের নির্দেশ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। আরও মনে রাখতে হবে যে,
    ইসহাক ছিলেন কনিষ্ঠ। অতএব হযরত ইসহাক (আ) এর যবীহ’ হওয়ার। হযরত ইসমাঈল (আ) ই ছিলেন হযরত ইবরাহীমের জ্যেষ্ঠ্য পুত্র ।
    হযরত । ব্যাপারে যেসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পেশ করা হল, এ গুলি দ্বারা দৃঢ় বিশ্বাস তাে। 1 দূরের কথা প্রবল ধারণারও সৃষ্টি হয় না। কাজেই এসব ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপেই মূল্যহীন। এ প্রসঙ্গে মাওয়াহিব গ্রন্থকার একটি গল্প বর্ণনা করেছেন যে, একদিন হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয এক ইয়াহুদীকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, হযরত ইবরাহীম (আ) এর পুত্রদ্বয়ের মধ্যে কাকে কুরবানী করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
    সে ইয়াহুদী পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। সে বলল, আল্লাহর কসম আমীরুল মু’মিনীন, ইয়াহূদিগণ ভালরূপেই জানে যে, এ নির্দেশ হযরত ইসমাঈল (আ) এর সম্পর্কে ছিল। কিন্তু তারা আপনাদের প্রতি বিদ্বেষ পােষণ করে, যেহেতু আপনাদের পিতা উত্তম । আল্লাহ তা’আলাও তাঁর কথাই বলেছেন।
    কাজেই তারা আপনাদের কথা অস্বীকার করে বলে যে, যাবীহ’ ছিলেন হযরত ইসহাক। আল্লামা শায়খ জালাল উদ্দীন সুয়ূতী তাঁর রচিত ‘রাসায়েলে’ও লিখেছেন যে, হযরত ইসহাকের যাবীহ’ হওয়ার কথা ইয়াহুদীদের একটি বিকৃত মত বৈ আর কিছু নহে। কিন্তু এ কথাও সম্পূর্ণরূপে গ্রহণযােগ্য নহে। কেননা, কোন কোন বিশিষ্ট মনীষীও এ কথা বলেছেন। (আল্লাহ সর্বজ্ঞা) …………….।।

    Leave a Reply