শায়খ (পীর) ধারণ করা, তরীকা গ্রহণ ও সুলুক (সাধনা) অবলম্বন করা
একথা প্রচলিত এবং অভিজ্ঞতার আলোকে স্বীকৃত যে, মানুষের বাতেনী ময়লা ও আন্তরিক রোগ ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করা এবং হাদীস দলীলের প্রেক্ষিতে নামায ও যাবতীয ইবাদত বন্দেগী হুজুরে কলব ও বিনয়ের সাথে আঞ্জাম দেয়া সহজ ও সম্ভব নয় একজন শায়খে কামেলের সোহবতে থেকে তাঁর দিক নির্দেশনা অনুসরণ করা ব্যতীত যিনি ঐ সব ব্যাধি ও ময়লা গুলোর চিকিৎসা সম্পর্কে অবগত ও অভিজ্ঞ। সত্যি কথা বলতে কি, ঐ সব রোগব্যাধিতে লিপ্ত কোন ব্যক্তি যদি তরীকতের একাধিক কিতাব মুখস্থ করে লয় তাহলে একজন শায়খে কামেলের সোহবতে থেকে যেরূপ তানিয়াত ও আত্মশুদ্ধি লাভ করা যায় তদ্রুপ তরবিয়াত ও আত্মশুদ্ধি পায় করা তার পক্ষে কস্মিন কালেও সম্ভব হবেনা। যেমনটা আমরা যুগের করা কথিত ফকীহগণকে দেখতে পাই যারা ঐ সব বাতেনী রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত। বহু অভিজ্ঞতা ও উদাহরণের দ্বারা এ বিষয়টি নিশ্চিত ও অকাট্য বাস্তবতায় উপনীত। এরশাদ হয়েছে-
অর্থাৎ মানুষ তার নিজের সম্পর্কে নিজেই চক্ষুযমান।
আল্লামা শেরানী (রহঃ) স্বীয় রচিত আনওয়ারে কুদসিয়া গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহর পথের অভিসারী আধ্যাত্মিক জগতের ছুফীসাধকগণের সর্বসম্মত মত এই যে, প্রত্যেক মানুষের প্রতি শায়খে কানেলের শরণাপন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক যিনি তাকে এ সব মারাত্মক আন্তরিক রোগ সমূহ ও কুরিপুগুলো থেকে মুক্ত করার পন্থা ও নিয়ম বাতলিয়ে দিবেন এবং তাকে আত্মশুদ্ধির মর্যাদায় পৌঁছে দিবেন। কেননা, ঐ সব কুরিপুই হলো সঠিক ও মকবুল ইবাদতের পথে একমাত্র বাধা ও অন্তরায়।
একথা সত্য যে, বান্দার প্রতি ইবাদত করা ফরজ যা আয়াতে কুরআনী দ্বারা সাব্যস্ত। আর ইবাদত শুদ্ধ ও গ্রহণ যোগ্য হওয়ার জন্য বাহ্যিক পবিত্রতার সাথে আন্তরিক পবিত্রতাও ফরজ। কুরিপুর সাথে মহান আল্লাহর ইবাদতের কোন মূল্য নেই। তাই, কু-প্রবৃত্তির লালন হারাম যার সম্পর্কে কঠিন শাস্তির কথা অসংখ্য আয়াত ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
বুঝা গেল যে, যে ব্যক্তি শায়খে কামেলের সান্নিধ্যে থেকে ঐ সব অসৎ গুণাবলী হতে মুক্তি লাভে সচেষ্ট হয় না সে বড়ই অপরাধী আল্লাহ পাক ও তদীয় রাসূলের দৃষ্টিতে। কেননা, যে ব্যক্তি রোগ চিকিৎসার পন্থা অবলম্বন না করে স্বীয় নফসের প্রতি অত্যাচার করেছে সে যদি শায়খের দিক নির্দেশনা ব্যতীত হাজার ও চেষ্টা সাধনা করে তাহলে কোন ফায়দা হবে না। যদিও সে হাজার ও কিতাব মুখস্থ করুক না কেন। যেমন, কোন ব্যক্তি একখানি ডাক্তারী কিতাব মুখস্থ করেছে, কিন্তু কোন্ ঔষধ কোন্ রোগের জন্য ব্যবহার করা।
উচিত এ নিয়ম নীতি তার জানা হয়নি। যারাই এ ব্যক্তিকে ঐ ডাক্তারী কিতাব মুখস্থ পড়তে শুনবে তারা তাকে একজন বড় ধরণের ডাক্তার বলে মনে করবে। কিন্তু তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হবে রোগের নাম ও উহার প্রতিষেধক সম্পর্কে তখন দর্শকগণ তাকে মূর্খ বলতে বাধ্য হবে।
সুতরাং হে সালেক! তুমি নিজের জন্য শায়খ ধর এবং কখনো একথা অমান্য করবেনা এবং পারলৌকিক জীবনের চির স্থায়িত্বের কথা চিন্তা কর। আর কখনো এ কথা বলবে না যে, ছুফীসাধকগণের তরীকা সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে কোন দলীল নেই। একথা নিসন্দেহে কুফরী । বস্তুতঃ সূফীয়ানে কেরামের প্রদর্শিত তরীকার সব কিছুই আখলাকে মুহাম্মাদিয়া, ছীরতে আহমাদিয়া ও সুনানে ইলাহিয়া ব্যতীত আর কিছুই নয় ।
আল্লামা শেরানী জাওয়াহের কিতাবে আরো বলেন, আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন্ ঔষধ ব্যবহার (আমল) করলে বান্দা থেকে খোদ পছন্দীর (আত্মম্ভরীতার) রোগ এবং রিয়ার (ইবাদতে লোক দেখানোর) রোগ দূর হয়?
আমি উত্তর দিলাম, বেশী বেশী আল্লাহ পাকের জিকর করা যাতে তার কলবে তৌহিদে হাকীকীর মর্ম উজ্জীবিত হয় এবং সে বুঝতে পারে যে, তার যাবতীয় আমল একমাত্র আল্লাহর সৃষ্ট, উহাতে একমাত্র বান্দার প্রতি নেসবত ও সম্পর্ক ব্যতীত আর কিছু নয়। এহেন অবস্থায় তার মধ্যে কোন প্রকার রিয়া ও উজ়ব (আত্মম্ভরীতা) স্থান পাবে না এবং কোন পাপীর উপর তার বড়াই বলতে কিছুই থাকবেনা। কেননা, বান্দা কখনো অন্যের আমল দ্বারা রিয়াকার হয় না এবং আত্মম্ভরীতা ও দাবী দাওয়ার অধিকারী হয় না।
কেউ যদি প্রশ্ন করে, কলেমায়ে তৌহিদের জিকর ব্যতীত অন্য কোন আমল আছে কিনা? আমি বলব, তৌহিদের চাইতে অধিক সফল ও তরীৎ প্রতিষেধক অন্য কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। তরীকতের শায়খ ও ওলামায়ে হক্কানী এ তৌহিদের জিকর ও ফিকরকেই মুরীদের জন্য একক অজীফা হিসেবে স্থির করে উহা দ্বারা তরীকার সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন।
এ মহাসত্যকে ভুলে গিয়ে একদল বান্দা তিলাওয়াতে কালামে পাক, নফল নামায ও রোজার আমলে বিশেষ ভাবে লিপ্ত হয়েছে ও হচ্ছে এবং রিয়া ও শাহওয়াতের উপর মৃত্যু বরণ করছে। কিন্তু ঐ সব আমালের ক্ষেত্রে তাদের আন্তরিকতা ও ইখলাস স্থান পায়নি। যেমন, আবেদের হাদীস এ কথার স্বাক্ষ্য প্রদান করে। হাদীসখানি হলো, মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন আবেদকে বলবেন, হে আবেদ! তুমি আমার রহমতে বেহেশতে প্রবেশ কর। তখন সে বলবে, হে আমার রব! আমি আমার আমলের দ্বারা বেহেশতে প্রবেশ করতে চাই।
তার এ জওয়াব এ জন্য যে, আবেদের একথা জানা নেই যে, পবিত্র কালামের উপকারীতা আত্মশুদ্ধির উপর নির্ভর করে। বস্তুতঃ কলবের ময়লা দূরীকরণে জিকর হলো আগুনের ন্যায় যা পিতলের মরিচা ক্ষনিকের মধ্যে দূর করে ফেলে। আর অন্যান্য ইবাদত হলো এক্ষেত্রে সাবান স্বরূপ। আল্লামা শেরানী (রহঃ) আরও বলেন, আল্লামা ইজ্জুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম শায়খ আবুল হাসান শাজুলীর সোহবত অবলম্বনের পূর্বে বলতেন, আমাদের নিকট যে ইলমে ফিকহ রয়েছে এ ছাড়া কি আরো অন্য কোন রাস্তা আছে নাকি যা আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভে সহায়ক? অর্থাৎ তার মতে ইলমে ফিকহই নৈকট্য লাভে যথেষ্ট, ইলমে তাসাউফের প্রয়োজন নেই।
কিন্তু যখন তিনি আল্লাহ পাকের অনুগ্রহে উক্ত শায়খের সোহবতে আসলেন তখন তিনি স্বীকার করলেন যে, তাসাউফ পন্থীদের অনুসৃত নীতি ও আদর্শ বিশুদ্ধ দলীলের আলোকে যথার্থ ও সঠিক বলে প্রমাণিত এবং একথাও স্বীকার করেছেন যে, তাসাওফের ধারক ও বাহকগণের সকলেই নীতি আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং যারা তাঁদের পরিপন্থি তারাই কেবল প্রচলিত প্রথা ও রীতির উপর পরিচালিত। তাসাওফ পন্থিদের থেকে কারামত ও অলৌকিক ঘটনাবলী প্রকাশ পায়।
পক্ষান্তরে, ফকীহগণ থেকে একটি কারামতও প্রকাশ পায় না যদিও তারা ইলমে দ্বীনের পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলমের অধিকারী হোক না কেন যে পর্যন্ত না তারা তাসাওফ পন্থীদের জীবনাদর্শের অনুসরণকারী হয়। উপরোক্ত বিষয়ে তিনি আরো বলেন, চার মাজহাবের অন্যতম প্রসিদ্ধ ইমাম আহমদ বিন হাম্বল তার পুত্র আব্দুল্লাহকে বলতেন, হে বৎস ইলমে হাদীস চর্চা কর, সাবধান, ঐ সব লোকের সোহবত অবলম্বন করবেনা যারা নিজেদেরকে ছুফীহিসেবে আখ্যায়িত করছে। কেননা, তারা প্রায়শঃ আহকামে দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ হয়ে থাকে। কিন্তু যখন তিনি আল্লামা আবু হামযা বাগদাদী (রহঃ) এর সোহবতে আসলেন এবং হাজারাতে সূফীয়ায়ে কেরামের নীতি আদর্শের পরিচয় লাভ করলেন তখন তিনি তাঁর পুত্রকে বলতে লাগলেন, হে বৎস! তোমার প্রতি ঐসব লোকের সোহবত অবলম্বন করা প্রয়োজন।
কেননা, তারা ইলমে দ্বীন, মুরাকাবা, আল্লাহ ভীতি, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ও অদম্য সাহসিকতায় আমাদের চাইতে অনেক অগ্রগামী। উক্ত বিষয়ে তিনি (আল্লামা শেরানী) আরো বলেন, আমাদের নিকট নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংবাদ পৌঁছেছে যে, হযরত ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) হাজারাতে সূফীয়ায়ে কেরামের সাথে উঠাবসা করতেন ও তাঁদের সোহবত অবলম্বন করতেন। এবং বলতেন, ফকীহগণ হাজারাতে সূফীয়ায়ে কেরামের ভাষা পরিভাষার পরিচিতি লাভের প্রতি মুখাপেক্ষী যাতে তাঁরা (সূফীয়ায়ে কেরাম) তাদেরকে তাদের অজানা বিষয় গুলো সম্পর্কে অবহিত করে উপকৃত করতে পারেন।
এ সম্পর্কে আল্লামা শেরানী (রহঃ) আরো বলেন, এ ব বলা যাবে না যে, বাতেনী রোগ ব্যাধিগুলোর চিকিৎসা যদি ফরজ তাহলে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও আয়েম্মায়ে মুজতাহেদীনের প্রেসিদ্ধ বিজ্ঞ পন্ডিতগণ এ বিষয়ে কিতাব প্রনয়ন করে যেতেন অথচ তুমি তাদেরকে এ বিষয়ে স্বতন্ত্র কিতাব প্রণয়নকারী দেখতে পাবে না। এ কথার উত্তরে বলবো, এসব বাতেনী রোগ-ব্যাধি যেগুলো আমাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে এসব রোগ ব্যাধি তাঁদের যুগে ছিলনা।
যদি তাঁদের যুগে এসব রোগ-ব্যাদি দেখা দিত তাহলে অবশ্যই তাঁরা এ বিষয়ে কিতাব প্রনয়ন করতেন এবং উহাতে ঐসব রোগ-ব্যাধির প্রতিষেধকের বর্ণনা পেশ করতেন এবং মানুষকে রিয়া, নেফাক, আত্মম্ভরীতা ইত্যাদি থেকে মুক্তিলাভের পথ বাতিয়ে দিতেন যেমন তারা প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে ফিকহের মাছয়ালা বাতিয়ে দেয়ার জন্য কিতাব লিখে গেছেন। কোন জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি কখনো বলতে পারবেনা যে, সে যুগের কোন ইমাম অন্য কোন ইমামের মধ্যে অহংকার বা আত্মম্ভরীতা বা রিয়া-হিংসা অথবা নেফাকী সম্পর্কে অবগত হয়ে উহার উপর তাকে স্থায়ীভাবে বহাল রেখেছেন। বরং তিনি কিতাব সুন্নাহ থেকে ঔষধ সংগ্রহ করে প্রকাশ করে দিয়েছেন যাতে করে তারা তাদেরকে ঐসব রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত করে দেন।
উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যার মধ্যে ঐসব বাতেনী রোগ-ব্যাধি সংক্রামিত হয়েছে তার প্রতি শায়খে কামেলের সোহবত অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক যিনি তাকে ঐ মারাত্মক রোগ-ব্যাধির অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবেন। যদি উপযুক্ত দক্ষ শায়খ তার অঞ্চলে দেশে না পাওয়া যায় তাহলে তার প্রতি ঐ উদ্দেশ্যে বিদেশ সফর করা বাঞ্চনীয়। হ্যাঁ, আল্লাহ পাক যাদের অন্তরকে ঐ সব রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখেন যেমন হাজারাতে মুজতাহেদীনে কেরাম ও তাদের কামেল শাগরেদগণ, তাহলে তাদের জন্য শায়খ সন্ধান অপরিহার্য নয়।
যদিও সুলুকের ক্ষেত্রে অধিক কামালিয়াত অর্জনের জন্য শায়খে কামেলের সাহচর্য অবলম্বনের প্রয়োজনীতা অনস্বীকার্য। যা হোক, এ সব লোকের জন্য শায়খের সাহচর্য অত্যাবশ্যক হয় না এজন্য যে, তারা যখনই যা জেনে নিয়েছে তখনই পরিচয় ইখলাসের সাথে আমল করেছে। আর এটাই সূফী লোকের প্রকৃত আল্লামা কুশাইরী (রহঃ) বলেন, মানুষের মধ্যে ঐ সব মারাত্মক রোগ ব্যাধি গুলো (অহংকার,হিংসা, রিয়া ও আত্মম্ভরীতা ইত্যাদি) সাধারণতঃ হিজরী তৃতীয় শতকের শেষ দিকে বিস্তার লাভ করতে থাকে। যেহেতু হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে-
অর্থাৎ হুজুর পাক (সাঃ) বলেন, সর্বোত্তম যুগ আমার যুগ, অতপর ঐ যুগ যে যুগের মানুষ আমার যুগের নিকটবর্তী, অতপর ঐ যুগ, যে যুগের মানুষ দ্বিতীয় যুগের নিকটবর্তী। তাই তিনি যে কয় যুগের মানুষের উত্তম হওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন তারাই পূর্ণ কামালিয়াত ও মর্যাদার অধিকারী |
আল্লামা কুশাইরী (রহঃ) আরো বলেন, প্রথমতঃ ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এবং ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহঃ) উভয়ে হাজারাতে সূফীয়ায়ে কেরামের অবস্থান বা মর্যাদা সম্পর্কে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন এবং তাঁরা তাঁদের জিকরের মজলিশেও শরীক হতেন। একদা তাদের উভয়কে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনারা এ সব জাহেল সূফীগণের ব্যাপারে কেন সন্দেহ বা ইতস্তুত করেন? তাঁরা উত্তর দিলেন, এ সব লোকের মধ্যে রয়েছে মৌলিক বস্তু তথা তাকওয়া (খোদাভীতি) হুব্বে ইলাহী ও মারেফতে সামাদী।
আল্লামা কুশাইরী (রহঃ) মাশারিকুল আনওয়ার কিতাবে বর্ণনা করেন, মহানবী (সাঃ) এর পক্ষ থেকে আমাদের হতে এ মর্মে সাধারণ অংগীকার নেয়া হয়েছে যে, যে ইলম তলব করার জন্য আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে উহা পুরোপুরি হেফজ ও আয়ত্ব করার উপরই যেন আমরা ধোকা না খাই যে পর্যন্ত না সে অনুযায়ী আমল করা হয়, যেমনটা আজকাল অধিকাংশ মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের আসলাফ (অতীত আলেম ও ইমামগণ) সে রকম ছিলেন না।
অতঃপর তিনি বলেন, উক্ত অংগীকার পুরোপুরী ও যথার্থভাবে রক্ষা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির পক্ষে একজন শায়খের সার্বিক পথ নির্দেশনা মান্য করা ব্যতীত বিকল্প কোন ব্যবস্থা শরীয়তের নেই যাতে করে তিনি তাকে মুরাকাবার মর্যাদা সমূহ ও খোদাভীতির মাকামে পৌছে দেন যার উপর উলামায়ে সলফ সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। আমি শায়খুল ইসলাম যাকারিয়া (রহঃ) বলতে শুনেছি যে, যে কোন ফকীহ হোক না কেন তিনি যদি আধ্যাত্মিক জগতের সাধকের সাহচার্য অবলম্বন না করেন তাহলে তিনি হবেন ঐ শুকনো রুটির ন্যায় যার সাথে তরকারী নেই। আমি আমার সাইয়্যেদ আলী খাওয়াছ (রহঃ) কে বলতে শুনেছি, ইলমে দীনের ছাত্র কামালিয়াতের মর্যাদায় পৌঁছতে পারবেনা যে পর্যন্ত না সে তরীকতের কোন শায়খের সাহচার্য অবলম্বন করবে।
কেননা, তরীকতের শায়খ তাকে কু- প্রবৃত্তির অন্ধকার এবং কলবী দ্বিধা দ্বন্দ্ব থেকে বের করে হেদায়েতের আলো দ্বারা উদ্ভাসিত করার ক্ষমতা রাখেন। যে ছাত্র তরীকতের পীরের সাথে সম্পর্ক তথা তার সোহবত এখতেয়ার করে না স্বভাবতঃ শয়তান তার উপর প্রাধান্য লাভ করে এবং সে ইলমের দাবীদার হয়ে যায় যা আল্লাহ প্রাপ্তির পথে বিরাট অন্তরায়। কিঞ্চিত আমলের অধিকারী প্রত্যেকেই নিজের জন্য এমন এমন দলীল কায়েম করে থাকে যেগুলো মহান আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। যে ব্যক্তি আমার এ কথায় সন্দেহ করে সে যেন পরীক্ষা করে দেখে নেয়।
অতএব, হে পথিক! তুমি অবশ্যই একজন শায়খে কামেলের দিক নির্দেশনা মান্য করে চলবে, তার খেদমত করবে, তার কঠোরতার উপর ধৈর্য্যধারণ করবে এবং সর্বাবস্থায় তাঁর সঠিক পরিচালনায় দৃঢ়ভাবে নিবেদিত থাকবে। কেননা, তিনি তোমাকে যে সব বিষয় সম্পর্কে অবহিত করবেন উহা তোমার জন্য খুবই সুন্দর ও কল্যাণময় হবে যার সাথে অন্যান্য দীনি কার্যাবলির দ্বারা মুকাবিলা করা যায় না। কেননা, ইলম হলো এক বিরাট নেতৃত্বের আসন যার মধ্যে কু-প্রবৃত্তি বহু ষড়যন্ত্র ও ধোকাবাজি বিদ্যমান রয়েছে।
অনেক সময় এসব ষড়যন্ত্র ও ধোকাবাজি ইলমে দ্বীনের মাশায়েখদেরও অগোচরে থেকে যায়। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে কোন প্রশ্নই হতে পারে না। মুসলিম শরীফ ও অন্যান্য হাদীসের কিতাবে বর্ণিত আছে যে, হে আল্লাহ! আমি এমন প্রবৃত্তি থেকে তোমার আশ্রয় চাই যে পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন ইলম হতে আশ্রয় চাই যা কোন উপকারে আসেনা। তাবরানী শরীফে আছে, ইলমের অধিকারীর জন্য তার ইলম দুভাগের বিষয়, তবে যে ব্যক্তি ইলম অনুযায়ী আমল করে তার কথা স্বতন্ত্র। উক্ত কিতাবে মারফু সূত্রে বর্ণিত, কিয়ামতের দিন ঐ আলেম সকলের চাইতে কঠিন শাস্তির অধিকারী হবে যাকে আল্লাহ পাক তাঁর ইলম দ্বারা উপকৃত করেননি।
আল্লামা কুশায়রী (রহঃ) বলেন, আল্লাহপন্থী লোকজন দুনিয়া ও আখেরাতের কোন বস্তুর দ্বারা আনন্দিত হন না। এসব কিছু তাঁদের প্রতি নেসবত করা না করা সমান। কেননা, মানুষের মধ্য হতে কেউ তাদের জন্য আল্লাহর সাথে তাদের কোন মালিকানায় পার্থিব ও পারলৌকিক স্বাক্ষ্য দিতে পারে না। বস্তুতঃ খোদা প্রাপ্তি ও তার সন্তুষ্টি লাভের বিষয়টি খুবই জটিল বা একজন শায়খে কামেলের তরবিয়ত ও সঠিক পরিচালনা (সুলুক) ব্যতীত লাভ করা সম্ভব নয়।
যদি তুমি সুন্দর সার্থক পন্থায় কল্যাণকামী হতে চাও তাহলে তোমার জন্য একজন পথনির্দেশনাকারী শায়খ ধর। অন্যথায়, অভিষ্টলক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হবে না যদিও জিন ইনসানের সম্মিলিত ইবাদতের সমান ইবাদত কর না কেন। এ থেকেই সালেকীন ও আবেদীনের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় তরীকত বিহীন আবেদ ইবাদতের মধ্যে বিশেষ ত্রুটির উপর শতাধিক বছর পর্যন্ত স্থির থাকে বদরুন তার ইবাদত শুদ্ধ অথবা কবুলিয়াতের মর্যাদা পায় না। পক্ষান্তরে, তরীকতপন্থী সালেক প্রাথমিক অবস্থায় ঐ ধরণের ত্রুটি হতে মুক্তি লাভ করে ফেলে। কেননা, তরীকতের শুরু হলো সঠিক মালিকানা একমাত্র আল্লাহর জন্য ঘোষণা করা।
অতঃপর তৌহিদে ফেলী, অবশেষে তৌহিদে অজুদীর সবক। পক্ষান্তরে, আবেদ তৌহিদের উক্ত তিনটি মর্যাদার স্বাদ আস্বাদন করতে পারে না। মহান আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি যে, যে ব্যক্তি আত্মশুদ্ধির জন্য শায়খে কামিল নির্বাচন করে নিয়েছে সে অবশ্যই তাঁর অভিষ্টলক্ষ্যে উপনীত হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঐ ব্যক্তি যে কোন শায়খে কামিলের শরণাপন্ন হয়নি বা শরণাপন্ন হয়ে তার উপদেশাবলী যথারীতি মান্য করেনি।
হযরত খাজা বাহাউদ্দীন নকশাবন্দি যিনি আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান রাশির ব্যাখ্যাকারদের অন্যতম প্রধান তিনি বলেন, আমাদের মতে আল্লাহ প্রাপ্তির সহজ ও নিকটতম পথ হলো নামায ও রোজা অর্থাৎ কোন অস্তিত্বই নেই মহান আল্লাহর অস্তিত্ব ও স্বত্বা ব্যতীত। যদিও নফিয়ে অজুদ মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের অন্যতম পন্থা, কিন্তু এ দুটি আমল দ্বারা আল্লাহ প্রাপ্তির মর্যাদায় পূর্ণতা লাভ হয়না যে পর্যন্ত না সালেক নফিয়ে অজুদের মর্যাদায় পৌছে।
আর এ জন্যই সালেক তার জাহেরী ও বাতেনী আমলের ক্ষেত্রে এমনি শক্তি ও সাহস অর্জন করে যা নামাযে ও রোযা দ্বারা অর্জন করতে পারে না। কেননা, নফিয়ে ওজুদ সালেকের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয় এবং তার গুণাবলীকে মুল্যহীন করে দেয়। এবং সে মহান আল্লাহর জন্য খালে, হয়ে যায়। আর এ অবস্থায় মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণারাজি তাকে।
বেষ্টন করে লয়। অতএব, তুমি ফরায়েজ ও সুন্নতে রাতেবা ব্যতীত তোমার অন্যান্য অজীফা গুলোর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবে না। কথিত আছে, তোমার অস্তি তুই হলো একটি গুনাহ বা অপরাধ। সুতরাং এ দিয়ে তোমার জন্য কো শুনাহের পরিমাপ করা যায় না।
সবারআল্লামা শায়খ ইবনে হাজর আসকালানী (রঃ) বলেন, রে উচিত নির্ভরযোগ্য শায়খে কামেল ধারণ করা এবং তার উচিত পদ্মপাত দুই লোকদের কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা। আর মাশায়েখে কেরামের মধ্যে যিনি অধিক পরহেযগার এবং শরীয়ত ও হাকীকতের নীতি নালা সম্পর্কে চাইতে বেশী বিজ্ঞ তাঁকেই নির্বাচন করা। স্বীয় অভ্যাস ও প্রচলিত রীতিনীতি পরিহার করা উচিত। এবং মনোনীত শায়খের ইশারার অধীনে থেকে সার্বিক আমলী জীবন গড়ে তোলা উচিত।
সত্যি কথা বলতে কি, যার ঐ ধরণের শায়খের সাহচর্য লাভ করার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁকে পরিত্যাগ করা তার জন্য হারাম। দলীল চতুষ্টয় তথা পবিত্র কুরআন, হাদীস, ইজমা ও বিশ্বাস তোমাকে এ সত্যের দিকেই পথপ্রদর্শন করবে এমনকি আসমানী সকল কিতাব ও একথারই স্বাক্ষ্য দিবে।