সত্য প্রতিষ্ঠায় ইমাম হুসাইন (রাদ্বি:)
হক বাতিলের লড়াই চির দিনের। আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) এর সন্তান। হাবিল-কাবিলের দ্বন্দের মাধ্যমে যে লড়াই শুরু হয়েছিল অদ্যবধি তা চলছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলবে।
সত্য সত্যই, সত্য কখনও একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়নি এবং হবেও না। বাতিল যখনই মাথাছাড়া দিয়ে ওঠেছে হকপন্থীরা জীবন বাজি রেখে, তাদের সহায় সম্বল নিয়ে এর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছেন এবং বাতিলকে পরাভূত করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
কারবালা ট্রাজেডী ছিল হক বাতিলের লড়াই। অযােগ্য, লম্পঠ, মদ্যপায়ী ও পাষন্ড ইয়াযিদ যখন সম্পূর্ণ গায়ের জোরে ইসলামী সাম্রাজ্যের আধিপতি হয়ে বলপূর্বক মানুষের কাছ থেকে বাইআত গ্রহণ করছিল, তখন প্রায় সকলই তার কাছে নতি স্বীকার করলেন এবং ইয়াযিদকে খলিফা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন কিন্তু তার পথের একমাত্র কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন নবী দৌহিত্র।
শেরে খােদা হযরত আলী ও নবী নন্দিনী হযরত ফাতিমা (রাদি:) এর নয়নমণি হযরত ইমাম হুসাইন (রাদ্বি:)। তিনি ইয়াযিদের অন্যায়, অনাচার, অবিচার ও পাপাচারের বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদী হয়েই দাঁড়ালেন না, তিনি পাপিষ্ট ইয়াযিদের বাইআত গ্রহণ করলেন না, বরং তিনি ঘােষণা দিলেন প্রাণ দিয়ে হলেও ইয়াযিদের দুঃশাসন থেকে মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষা করতে হবে। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবনা, সত্যকে এ যমীনে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। তাই তিনি ৬১ হিজরীর দশই মুহাররাম পবিত্র আশুরার দিনে ইয়াযিদের নির্দেশে প্রেরিত ইবনে যিয়াদের বাহিনীর মােকাবেলা করেন ফোরাতের তীরে, কারবালা প্রান্তরে। আহলে বাইআতের ১৬ জন সহ সর্বমােট ৭১ জন সঙ্গী নিয়ে অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে কারবালার ময়দানে বীরদর্পে লড়াই করে শাহাদত বরণ করে তিনি প্রমাণ করলেন যে, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়ােজনে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়।
প্রাণ উৎসর্গের এ ঘটনার মাধ্যমে ইমাম হুসাইন (রাদ্বি:) কিয়ামত পর্যন্ত হয়ে গেলেন সত্য প্রতিষ্ঠার উৎস ও আলােকবর্তিকা। তাইতাে মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ জওহর কতইনা সুন্দর বলেছেন “ইসলাম জিন্দাহ হােতা হয় হর কারবালা কে বাদ” |
কারবালার এ নৃশংস হত্যাকান্ড ও তার দুশ্চরিত্রতার কারণে ইয়াযিদ সর্ব যুগেই মুসলিম মিল্লাতের নিকট ধিকৃত, নিন্দিত ও কুখ্যাত হয়ে আসছে। কিন্তু অত্যন্ত । পরিতাপের বিষয় সম্প্রতি এক শ্রেণীর লােকের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যারা । ইয়াযিদের পক্ষাবলম্বন করে তার সাফাই গাইতে গিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেছে।
এবং তাকে মুজাদ্দিদ তথা সংস্কারক খিতাবে ভূষিত করছে, পক্ষান্তরে ইমাম হুসাইন। (রাদ্বি:)কে একজন ক্ষমতালােভী হিসেবে আখ্যায়িত করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করছে। (নাউযুবিল্লাহ)। এ সকল কুলাংগার তাদের এ ভ্রান্ত ও মনগড়া মতবাদ তাদের বক্তৃতা । লিখনী ও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করছে এ ব্যাপারে একটু।
আলােকপাত করতে চাই। ইয়াযিদ ২৫ হিজরী মতান্তরে ২৬ হিজরী সনে জন্ম গ্রহণ করে। তাই সে নিঃসন্দেহে একজন তাবেয়ী এবং ভাল যুগের মানুষ। কিন্তু ইয়াযিদের চারিত্রিক সখলন, কারবালার হত্যাযজ্ঞ, পরবর্তীতে পবিত্র হারামাইন শরীফাইনের অবমাননা ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবায়ে
হারে শহীদ করার কারণে সে এ মর্যাদার আসন থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে।
হারে শহীদ করার কারণে সে এ মর্যাদার আসন থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে।
এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের উলামায়ে কেরামের সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত। তবে তাকে লা’নত বা অভিসম্পাত করা যাবে কিনা এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতবিরােধ পরিলক্ষিত হয়। অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে ইয়াযিদকে লা’নত করা যাবে। কারণ হুসাইন (রাদ্বি:) এর শাহাদতের ব্যাপারে তার প্রত্যক্ষ নির্দেশ ও সম্মতি ছিল। এমনকি সে এ হত্যাযজ্ঞে খুশি ও উফুল্ল ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে যখন সারা দুনিয়া থেকে এ বর্বর হত্যাকান্ডের নিন্দার ঝড় উঠল তখন সে একটু অনুতপ্ত হয়েছিল।
এজন্য কেহ কেহ তার ব্যাপারে কঠোর মনােভাব পােষণ করে তাকে কাফের বলতে ও দ্বিধাবােধ করেন নি। তবে প্রকৃত কথা হলাে সে মু’মিনে ফাসিক। আবার কেহ কেহ বলেছেন যে, তাকে লা’নত দেয়া যাবেনা যেহেতু
সে মু’মিন ও আহলে কিবলা। আবার ইমাম গাজ্জালী (রাহ:) কাজী মাওলানা ছানাউল্লাহ পানিপথী (রাহ:) সহ কিছু সংখ্যক উলামায়ে কেরামের মতে তাকে লানত করা বৈধ তবে লা’নত করে লাভ কি? আল্লাহর নিকট যা পাওয়ার তা এমনিতেই পাবে।
সে মু’মিন ও আহলে কিবলা। আবার ইমাম গাজ্জালী (রাহ:) কাজী মাওলানা ছানাউল্লাহ পানিপথী (রাহ:) সহ কিছু সংখ্যক উলামায়ে কেরামের মতে তাকে লানত করা বৈধ তবে লা’নত করে লাভ কি? আল্লাহর নিকট যা পাওয়ার তা এমনিতেই পাবে।
“মা ছাবাতা বিসসুন্নাহ” কিতাবে হযরত শাহ আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ:) মুসলিম শরীফের একটি বর্ণনা দ্বারা প্রমাণ করেছেন ইয়াযিদ লানতের উপযুক্ত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
من اخاف المدينة اخافه الله و كانت عليه لعنة الله والملائكة والناس اجمعین۔
من اخاف المدينة اخافه الله و كانت عليه لعنة الله والملائكة والناس اجمعین۔
অর্থাৎ- যে মদীনাবাসীকে ভীত সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহ তা’লা তাকে ভীত সন্ত্রস্ত করবেন এবং তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতাকুল ও সমগ্র মানবজাতির লা’নত বর্ষিত হবে।”
ইয়াযিদই হাদীসে উল্লেখিত লা’নতের উপযুক্ত ব্যক্তি। কারণ- ৬৩ হিজরীতে ইয়াযিদের নিকট খবর পৌছল যে, মদীনাবাসী ইয়াযিদের বাইআত ভঙ্গ করেছেন। তখন ইয়াযিদ অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে মদীনাবাসীকে সমূচিত শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী বাহিনী মদীনা শরীফ প্রেরণ করল। তারা মদীনাবাসী ও মসজিদে নববীর
যে অবমাননা করেছিল তা সত্যিই রােমহর্ষক। ইতিহাসে তা হাররার যুদ্ধ নামে খ্যাত। হাররার যুদ্ধ এতই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক যা প্রকাশ করার কোন ভাষা আমাদের নেই।
যে অবমাননা করেছিল তা সত্যিই রােমহর্ষক। ইতিহাসে তা হাররার যুদ্ধ নামে খ্যাত। হাররার যুদ্ধ এতই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক যা প্রকাশ করার কোন ভাষা আমাদের নেই।
ইমাম হাসান বসরী (রহ:) এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে
লিখেন, অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরাম ইয়াযিদ বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন।
লিখেন, অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরাম ইয়াযিদ বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন।
হাজারাে কুমারী মহিলাদের সম্ভম হানি ঘটে এবং পবিত্র মদীনা লুষ্ঠিত হয়। অপর
এক বর্ণনায় পাওয়া যায় ইয়াযিদ বাহিনী মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে ঘােড়া বেঁধে রাখে এবং তিনদিন পর্যন্ত মসজিদে নববীতে আজান ও ইকামত বন্ধ ছিল।
এক বর্ণনায় পাওয়া যায় ইয়াযিদ বাহিনী মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে ঘােড়া বেঁধে রাখে এবং তিনদিন পর্যন্ত মসজিদে নববীতে আজান ও ইকামত বন্ধ ছিল।
হযরত বলেন ইয়াযিদের অনাচার ও পাপাচার এমন পর্যায়ে। যে গেম যে, আমরা সবাই তটস্ত থাকতাম যে, কবে জানি আসমান থেকে । ইর ২ এর উপর নাযিল হয়ে যায়। কেননা ইয়াযিদের শাসনামলে তার। এত চর তন্ত্রে মেয়েদেরকে, সহােদর বােনদেরকে এবং সমালেবকে। বিবাহ করা শুরু করে দিয়েছিল।
অধিকন্তু ইয়াযিদ নিজেই মদ্যপায়ী এবং বেনামা হল নাউযুবিল্লহ (মা সাবাতা বিসুন্নাহ)। ইয়াযিদ বাহিনী শুধু মদীনা মুনাওয়ারায় হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা মক্কা শরীফে ২৪ হিজরীতে হামলা চালায়, পবিত্র কাবা শরীফের ছাদ ও গিলাফ আগুন দিয়ে ভুলিয়ে দেয় এবং হযরত ইসমাঈল (আ:) এর বদলে যে বেহেস্তী দুম্বা কুরবানী দেয়া হয়েছিল উহার শিং কা’বা শরীফে সংরক্ষিত ছিল তাও জ্বালিয়ে দেয়। (নাউযুবিল্লাহ)। যে ইয়াযিদকে আজ মুজাদ্দিদের মর্যাদায় ভূষিত করা হচ্ছে সে ইয়াযিদের শানে লকে সালিহিনের কেহ কোন বিশেষণ লাগিয়ে ডাকাকে শুধু অপরাধই মনে করেন নি বরং তাৎক্ষণিক শান্তি ও দিয়েছেন। যেমন নওফল বিন ফুরাত (রাহঃ) বর্ণনা। করেন যে,
আমি উমাইয়া খলিফা উমর বিন আব্দুল আযিয (রাদ্বি:) এর দরবারে বসা হলাম, এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি ইয়াযিদের আলােচনা করতে গিয়ে বলে উঠল। আমিরুল মুমিনীন ইয়াযিদ। তখন খলিফা উমর বিন আব্দুল আযিয (রাদ্বি:) ঐ ব্যক্তিকে ধমক দিয়ে বললেন তুমি ইয়াযিদকে আমীরুল মু’মিনীন বলে জঘন্যতম অপরাধ করেছ। অত:পর শাস্তিস্বরূপ ঐ ব্যক্তিকে তিনি ২০টি বেত্রাঘাত করেন।
পরিশেষে বলব এত সব আকাম-কুকামের হােতা, সর্বকালে ও সর্বযুগে ঘৃণিত ও বিকৃত ই যিদকে ভাল মানুষ বলে যারা সাফাই গায় আমরা নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে তাদেরকে ইয়াযিদের দলভূক্ত বলে আখ্যায়িত করতে পারি এবং হুসাইন (রাদ্বি:) তথা আহলে বাইতের ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিপক্ষ হিসেবে
চিহ্নিত করতে পারি । আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত হুসাইন (রাৰিঃ) ছিলেন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, তিনি ক্ষমতা দখল করা কিংবা খলিফা।
চিহ্নিত করতে পারি । আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত হুসাইন (রাৰিঃ) ছিলেন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, তিনি ক্ষমতা দখল করা কিংবা খলিফা।
হওয়ার লােভে ইয়াযিদের বিরুদ্ধাচরণ করেননি। বরং ইয়াযিদের অন্যায় ও পাপাচারের সমুচিত জবাব দেয়া ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে জনমত গড়ে তুলতে কুফাবাসীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছিলেন। তাই এটা ছিল হক বাতিলের লড়াই, সত্য-মিথ্যার লড়াই, ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লড়াই। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত হক পন্থীরা ইমাম হুসাইন (রাদ্বি:) এর শাহাদাত থেকে অনুপ্রেরণা সঞ্চয় করে হক প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে বাতিল পন্থীরা পাষন্ড ইয়াযিদের পথ অনুসরণ করে বাতিলের অতল গহবরে তলীয়ে যাবে ।